ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঋণের জালে আটকা পড়েছেন বিরলের বহু মানুষ

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক
আপলোড সময় : ১৭-০৮-২০২৪ ০২:০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ১২-১০-২০২৪ ১১:০০:২৪ অপরাহ্ন
ঋণের জালে আটকা পড়েছেন বিরলের বহু মানুষ
দিনাজপুরের বিরলে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। ঋণে জর্জরিত হয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে আত্মহননের মতো পথ বেছে নিচ্ছে। অনেকে ভয়ে পারছে না ঘর থেকে বের হতে। আবার কেউ কেউ বাড়ি ও পরিবার ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। এমনই দৃশ্য উপজেলার ভান্ডারা ইউপির সংখ্যালুঘু হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ভান্ডারা গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি উপজেলার রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের মির্জাপুর গ্রামের খোরশেদ আলী মাস্টারের ছেলে দাদন ব্যবসায়ী মনিউল ইসলাম মনির কাছ থেকে চড়া সুদে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেয় একই উপজেলার ভান্ডারা উত্তরপাড়া গ্রামের গ্রামের মৃত পেবো চন্দ্র সরকারের ছেলে দুয়ারু চন্দ্র সরকার (৬৫)। সঠিক সময় ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তিনি টাকা বেড়ে কয়েক গুণ হয়ে যায়। অবশেষে দাদন ব্যবসায়ী মনিউল ইসলাম মনি ও তার লোক জনের হুমকি ও ভয়ভীতির কারণে তিনি গত সোমবার (১৫ জুলাই) কীটনাশক জাতীয় গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

এ ব্যাপারে ভীতি সন্ত্রস্ত হয়ে মৃত. দুয়ারু চন্দ্র রায়ের পরিবারের কেউ মুখ না খুললেও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, ওই গ্রামের গুণধর চন্দ্র রায়ের ছেলে ঋণগ্রস্ত এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তি জয়রাম চন্দ্র রায় (৩৮)। তিনি জানান, দুয়ারু চন্দ্র রায় মনিউল ইসলাম মনির কাছ থেকে কিছুদিন আগে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে চড়া সুদে টাকা নেয়। পরে টাকা দিতে না পেরে তিনি দাদন ব্যবসায়ীর ভয়ে আত্মহত্যা করে।

তিনি জানান, আমাকেও হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। কারণ আমিও তার কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে ৩ মাস আগে ৪৫ হাজার টাকা কর্জ নিয়েছি। ৩ মাসে আমি তাকে ৬১ হাজার ৫ শত টাকা দিয়েছি। তিনি আরও আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা দাবি করে।

 না হলে তিনি তার লোকজন দিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করবে। আমি ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। অনবরত আমাকে বিভিন্ন ভয় ভীতি দেখানোসহ হুমকি দেওয়া হচ্ছে।একই গ্রামের যগিন চন্দ্র রায়ের ছেলে ভুক্তভোগী পহেলু চন্দ্র রায় (৩৫) জানান, আমিও ফাঁকা স্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে মনির কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা কর্জ নিয়েছিলাম।

 পরে আমাকে জানানো হয়, গ্রহণকৃত টাকার প্রতি সপ্তাহে প্রতি হাজারে ২ শত টাকা সুদ বহন করতে হবে। আমি তাকে ৬০ হাজার টাকা দেয়ার পরেও আমার কাছে তিনি আরও ৬০ হাজার টাকা দাবি করে। আমি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মনিউল ইসলাম মনি ও তার ভায়রা ভাই রবিপুর গ্রামের রইসুলসহ তাদের সন্ত্রাসী প্রকৃতির খইটাল বাহিনী আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে ভয়ভীতি দেখায় এবং হয়রানি করে। 
অবশেষে আমি বসত বাড়ি বিক্রি করে তাকে টাকা দিয়ে ঋণমুক্ত হই। এই দাদনের টাকার কারণে আমি মাথার গুজার ঠাঁই টুকুও অবশেষে হারালাম। এখন পরিবার পরিজন নিয়ে কথা গিয়ে আশ্রয় নিব, তা জানি না।

একই গ্রামের রষনী চন্দ্র রায়ের ছেলে ভুক্তভোগী মানিক চন্দ্র রায় (৩২) ওরফে টিকি মানিক জানান, আমি মনির কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ঋণ নেই। এর মধ্যে আমি একমাসের মধ্যে ১ হাজার টাকা পরিশোধ করি। এর ২ মাসপর মনির ভায়রাভাই রইসুল টাকার কারণে আমার ব্যবহৃদ একটি বাইসাইকেল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। যার আনুমানিক মুল্য ৪ হাজার টাকা হবে।

 বাইসাইকেলটি নিয়ে যাবার কারণে আমি মনে করেছিলাম যে, আমার টাকা হয়তো পরিশোধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় ১ বছর পর তারা আবার আমার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করছে। না হলে নাকি তারা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে এবং নির্যাতন করবে। তাই আমি খুবই ভয়ের মধ্যে আছি।

ভান্ডারা কালিতলা গ্রামের অমথ চন্দ্র সরকালের ছেলে ভুক্তভোগী নীরেশ চন্দ্র সরকার (৩২) জানান, আমি ৫০ হাজার টাকা কর্য্য নিয়ে ৩ মাসের ব্যবধানে ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। আমাদের এই হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির মানুষ দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণে জর্জরিত। 

এমন সুদ বা দাদনের টাকার ঘটনায় ১ বছরের ব্যবধানে ভান্ডারা গ্রামের আরোও ২ ব্যক্তি দুয়ারু চন্দ্র রায়েরমত একই ভাবে আত্মহত্যা করেছে। তারা হলেন, কাঠু আর্মির ছেলে বাংকু (৪৫) এবং যতিন চন্দ্র রায়ের ছেলে সত্যজিৎ উৎপল (২৫)। দাদন ব্যবসায়ীদের টাকার চাপ সইতে না পেরে বাড়ি ও পরিবার ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে একই গ্রামের সাদিকুল নামের এক যুবক।

এ ব্যপারে দাদন ব্যবসায়ী মনিউল ইসলাম মনির কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, যারা আত্মহত্যা করেছে আমি তাদের চিনিনা। আমি তাদের কোন টাকা দেই নাই। তবে হ্যা, আমার সিসি ঋণের টাকা আছে। কেউ চাইলে হয়তো দেই। আমি যেহেতু সিসি ঋণের টাকা ব্যাংকে সুদ দেই। আমিও কাউকে টাকা দিলে সুদ নেই। তবে কাউকে আমি কোনদিন টাকার জন্য ভয়ভীতি দেখানো বা নির্যাতন করি নাই।

উপজেলার ৬নং ভান্ডারা ইউপি চেয়ারম্যান মামনুর রশীদ মামুন জানান, আমার ইউনিয়নে দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য ব্যপকভাবে বেড়ে গেছে। অনেকে দাদন ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে বলে আমি খবর পেয়েছি। তাই আগামী ১ সপ্তহের মধ্যে সকল দাদন ব্যবসায়ী ও আমার ইউনিয়নের ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের এক জায়গায় করে একটি যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের চেষ্টা চালাচ্ছি।

এব্যাপারে বিরল উপজেলা সমবায় অফিসার হাফিজুর রহমান জানান, সমবায় নীতিমালা বা সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোন সংগঠন বা ব্যাক্তির ঋণ কার্যক্রম চালানোর কোনো প্রকার বৈধতা নাই।

বিরল থানার ওসি গোলাম মাওলা শাহ জানান, বিষয়টি আমি শুনেছি। এক শ্রেণির অসাধু মানুষ, সাধারণ মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করছে। তবে কেউ এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করে নাই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

বিরল ইউএনও বহিৃ শিখা আশার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এব্যাপারে কেউ কোন লিখিত অভিযোগ করে নাই। অভিযোগ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dinajpur TV

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ